অনান্য

▌হে পথিক : আমিও একদিন তোমার মত ছিলাম!

হে পথিক : আমিও একদিন তোমার মত ছিলাম! 

যোহরের নামযটা শেষ করলাম, সাথে সাথেই ফোনটা বেঁজে উঠল, একটি বিশেষ কাজে এখনই বের হতে হবে। উতপ্ত রোঁদে ধূ ধূ মরুভূমি, কপাল বেয়ে নামে ঘামের ফোঁটা, কিন্তু তারপরও রিজিকের অন্বেষণে বিশ্রামহীন ছুটে চলা এই নিয়েই আমার প্রবাস জীবন!

ছয়'শ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে যখন ফিরছি, রাত তখন দশটা। চারিদিক নিরব নিস্তব্দ। কোথাও কোন সাড়া শব্দ নেই। রাতের অনেক অংশ এখনও বাকী কিন্তু আশেপাশে কাউকে দেখছিনা। রাস্তার লাইটগুলিও বন্ধ, ঠান্ডা বাতাসের সাথে ধূলোবালি উড়ছে। এদিকে এশার নামাযটাও পড়া হয়নি। চতুর্দিকের কোথাও মসজিদের মিনার নজরে আসছে না। খানিকটা সামনে যেতেই বাউন্ডারী ওয়াল করা একটি মসজিদের সন্ধান পেলাম।

অত:পর গেইটের ভিতরে প্রবেশ করেই অন্তরটা কাঁপুনি দিয়ে উঠলো! হায়, হায় এ তো দেখি গণ-কবরস্থান। দুপাশে শত শত কবর আর মধ্যখানে সরু রাস্তাটা চলে গেছে মসজিদের দরজার দিকে। তড়িৎ গতিতে গিয়ে অজু করে এশার ছালাত আদায় করলাম। তারপর বাহিরে এসে মিনিট পাঁচেক দুপাশে কবরগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলাম, হৃদয়টা কেমন যেন কোমল হতে শুরু করল। অত:পর সামনের দিকে হাঁটা শুরু করলাম...
.

দক্ষিণদিকে কয়েকটা নতুন কবর দেখা যাচ্ছে, সম্ববত দু'একদিন আগেই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। হয়ত অল্প কিছুদিনই দুনিয়ার বুকে বিচরণ করেছিলেন!  পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, মৃত্যুর পরেও এই কবরস্থানে তাঁরা ছয়মাসের বেশী থাকতে পারবেন না, নতুনদের আগমনে পুরানাদের বিদায় ঘন্টা বেজে যাবে। মাথার খুলি, দেহের হাড়গুলি উঠিয়ে ফেলা দেয়া হবে! এখানে ভি আই পি থেকে শুরু করে বে-ওয়ারিশ সবার কবর রয়েছে। ইয়েমেনী, সুদানী, মিশরী, কেরালা, পাকিস্তানী, বাংলাদেশীদের কবরগুলো দেখে চোখের পানি আপনা-আপনিই গড়িয়ে পড়ল!

ইতোমধ্যে দুজন খাদেম প্রবেশ করলেন, তাঁরা বলাবলি করছে যে, কবর খুঁড়তে হবে, সকালে নাকি দুজন নতুন মেহমান আসছেন। হতভম্ব হয়ে গেলাম, হায় আল্লাহ! এ কোথায় দাঁড়িয়ে আছি আমি!? কিছুক্ষণ আকাশ পানে তাকিয়ে রইলাম। মুহুর্তের মধ্যেই দুনিয়াবী সকল পেরেশানী দূর হয়ে গেল! এই কবরস্থান এমন এক জায়গা যা ব্যক্তির সমস্ত অহংকারকে নিঃশেষ করে দেয়। আমাদের সালাফগন যখন কোনো কবরের পাশ দিয়ে যেতেন তখন নিরব -নিথর হয়ে যেতেন, আল্লাহর ভয়ে সেজদায় লুটিয়ে পড়তেন, খুব কাঁদতেন আর নিজেকে তিরস্কৃত করতেন।
.

উছমান [ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ] যখন কোন কবরের নিকট দাঁড়াতেন তখন তিনি অঝরে কাঁদতেন। তিনি এতটাই কাঁদতেন যে, চোখের পানিতে তাঁর দাড়িগুলো ভিজে যেত। তাঁকে প্রশ্ন করা হল, জান্নাত-জাহান্নামের বর্ণনায় আপনি কাঁদেন না, অথচ কবর দেখলেই আপনি এত কাঁদেন কেন?

জবাবে তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ  ﷺ- বলেছেন,
‘কবর হ’ল পরকালের যাত্রাপথের প্রথম মনযিল। যদি এখানে কেউ মুক্তি পায় তাহ’লে পরের মনযিলগুলি তার জন্য সহজ হয়ে যায়। আর যদি এখানে মুক্তি না পায় তাহ’লে পরেরগুলি আরও কঠিন হয়ে যায়’।
রাসূলুল্লাহ  ﷺ- আরো বলেছেন, ‘আমি কবরের চাইতে ভয়ংকর কোন দৃশ্য আর দেখিনি’।
----- [ তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, মিশকাত  :১৩২ ]
.

বারা বিন আযেব [ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ] থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, "একদা আমরা রাসূলুল্লাহ  ﷺ-এর সাথে ছিলাম। হঠাৎ তিনি একদল লোককে দেখতে পেয়ে বললেন, ওরা কি উদ্দেশ্যে এখানে একত্রিত হয়েছে? একজন বললেন, এরা একটি কবর খুঁড়ছে।
রাবী বলেন, একথা শুনে রাসূলুল্লাহ  ﷺ- আতংকিত হয়ে পড়লেন এবং সঙ্গী-সাথীদের আগেই দ্রুতবেগে কবরের নিকটে পৌঁছে হাঁটু গেড়ে বসলেন।

রাবী বলেন, তিনি কি করছেন তা দেখার জন্য আমি তাঁর মুখোমুখি বসলাম। তিনি কেঁদে ফেললেন, এমনকি অশ্রুতে মাটি পর্যন্ত ভিজে গেল। অতঃপর তিনি আমাদের দিকে ফিরে বসে বললেন, হে ভাইয়েরা!
এ রকম দিবসের জন্য রসদ প্রস্তুত করে রেখো’।
---- [আহমাদ, সিলসিলা ছহীহাহ  : ১৭৫১ ]
.

প্রিয় সর্তীর্থবৃন্দ,
মৃত্যুর একটা ঝাপটা দুনিয়ার সকল ব্যস্ততার অবসান ঘটিয়ে দিবে। স্থায়ী বাসিন্দা হবার আগে মাঝেমধ্যে কবরস্থানে ঘুরে আসুন। আপনার প্রিয় মানুষদের কবরের পাশে দাঁড়ান। সেই সময়গুলোর কথা স্মরণ করুন যখন তারা ছিলেন সুস্থ-সবল এবং অবস্থান করছিলেন আপনার মাঝেই। সেই কবরবাসীদের জায়গায় নিজেকে কল্পনা করুন।
.
উন্মুক্ত মন ও উন্মুক্ত অন্তর নিয়ে যান, ভাবুন মৃত্যুকে নিয়ে, মৃত্যু পরবর্তী জীবন নিয়ে; এই ভাবনাই যেন মৃত্যু এবং আখিরাতের জন্য আপনাকে প্রস্তুতি নিতে প্রেরণা জোগায়। নিশ্চয়ই মৃত্যুচিন্তা মৃত অন্তরকেও জীবিত করতে পারে। আসার সময় শেষবারের মত পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, কবরে শানিত মানুষগুলি যেন চিৎকার করে বলছে - "হে পথিক ! আমিও একদিন তোমার মত ছিলাম।"
.

হে আমাদের রব! আপনার কাছে উত্তম ও বরকতপূর্ণ মৃত্যু এবং কবরের যাবতীয় ফিতনা থেকে মুক্তি চাই!  [ আ-মীন ]
.
.
.

আপনাদের দ্বীনীভাই,
আখতার বিন আমীর।

আল্লাহ ভাইকে জাযায়ে খাইর দান করুন!
▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬


আরও নতুন পোষ্ট পরবর্তী পোষ্ট

Related Posts

Facebook