ইসলামিক ইতিহাস

হিজরী ৯ম বর্ষের কিছু ঘটনা (সীরাহ)

আর দশজন সহজ স্বাভাবিক দম্পতির মতই আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবনেও ছিল আনন্দ-বেদনার গল্প, ছিল বাদানুবাদ আর মান-অভিমানের উত্থান-পতন। একবার এমন হয়েছিল, স্ত্রীদের সাথে অভিমান করে আল্লাহর রাসূল (সা) দীর্ঘ এক মাস বাড়ির বাইরে কাটান। পুরো সময়ে তিনি তাঁর কোনো স্ত্রীর কাছেই যান-নি। ঘটনাটা নবম হিজরির।  
 
একদিন আবু বকর (রা) রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে দেখা করতে গিয়ে দেখলেন আরও অনেকেই রাসূলের ঘরের দরজায় অপেক্ষমান। কাউকেই ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। আবু বকর (রা) ভেতরে প্রবেশের অনুমতি চাইলে তাকে অনুমতি দেওয়া হলো। এরপর উমার (রা) এলেন, তাকেও অনুমতি দেওয়া হলো। আল্লাহর রাসূল (সা) নিচে বসে আছেন আর চারপাশ ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে উনার স্ত্রীরা। সবার মধ্যে বিষাদের ছাপ। পুরো পরিবেশ থমথমে হয়ে আছে। গুমোট ভাবটাকে হালকা করার জন্য উমার (রা) মজা করে বললেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমার টাকা-পয়সা নেই জেনেও যদি আমার বউ তার পেছনে খরচ করার জন্য আমাকে পীড়াপীড়ি করতো, তাহলে আমি তার ঘাড় ভেঙে দিতাম!’ উমারের কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সা) হেসে দিলেন, বললেন, ‘এখানেও তা-ই হয়েছে! আমার চারপাশে যাদের দেখতে পাচ্ছো তারাও আমার কাছে ধন-সম্পদ চাইতে শুরু করেছে!’   
 
এ কথা শুনেই আবু বকর (রা) নিজ কন্যা আইশার (রাহা) দিকে এগিয়ে গেলেন আর উমার (রা) এগিয়ে গেলেন নিজ কন্যা হাফসার (রাহা) দিকে। দুজনেই আল্লাহর রাসূলের দুই স্ত্রীর বাবা! উমার (রা) বললেন, ‘তোমরা নবীজির কাছে এমন কিছু দাবি করছো, যা তাঁর কাছে নেই!’ তারা উত্তর দিলেন, ‘আমরা কখনো এমন কিছু দাবি করবো না যা আল্লাহর রাসূলের কাছে নেই।’ এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাসূল (সা) স্ত্রীদের থেকে এক মাস আলাদা ছিলেন। আর সেই সময়ে আল্লাহ তাআলা কুরআনের এই আয়াত নাযিল করেন।

“হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীদের বলে দিন, তোমরা যদি পার্থিব জীবনের ভোগ ও এর বিলাসিতা কামনা করো, তাহলে এসো, আমি তোমাদের ভোগ-বিলাসের ব্যবস্থা করে দিই এবং সৌজন্যের সাথে তোমাদের বিদায় করি। আর যদি তোমরা আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও পরকালকে কামনা করো তাহলে তোমাদের মধ্যে যারা সৎকর্মশীল, আল্লাহ তাদের জন্য মহা প্রতিদান প্রস্তুত করে রেখেছেন।” (সূরা আহযাব, ৩৩: ২৮-২৯)
  
আল্লাহর রাসূলের লাইফস্টাইল (সা) আর দশজনের মতো সহজ আর স্বাচ্ছন্দ্যময় ছিল না, আরাম কী জিনিস তিনি জানতেন না। তিনি ছিলেন আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় বান্দা -- নেতৃত্ব, খ্যাতি, ধন-সম্পদ তাঁকে হাতছানি দিয়ে ডেকেছে। কিন্তু সেই ডাককে তিনি কোনো পাত্তাই দেননি, এমনভাবে জীবন কাটিয়েছেন যেন দুনিয়ার চেয়ে সস্তা আর অর্থহীন বস্তু আর দ্বিতীয়টি নেই। মদীনায় আসার পর মসজিদে নববীর পাশে আল্লাহর রাসূল (সা) আর উম্মুল মুমিনীনদের জন্য ঘর তৈরি করা হয়। সে ঘর ছিল নিতান্তই সাধারণ। রাজা-বাদশাদের প্রাসাদের মতো প্রকাণ্ড কিছু তো ছিলই না, বরং কাদামাটি আর পাথর দিয়ে তৈরি ছোট কয়েকটা মাথা গোঁজার ঠাই। সেগুলোকে বড়জোর কুঁড়েঘর বলা চলে। আরবের মরুভূমিতে সবচেয়ে সহজলভ্য খেজুরের ডাল ছিল সেই ঘরের চালা। ঘরের ছাদগুলো এত নিচু ছিল যে ছোটখাট লোকও নিমিষে হাত দিয়ে ছুঁতে পারতো। ইমাম হাসান আল বসরী বলেন, ‘আমি আল্লাহর রাসূলের (সা) ঘর দেখেছি। হাত বাড়ালেই এর ছাদ ধরা যায়।’   
 
আল্লাহর রাসূলের সেই ঘরে আলো জ্বালানোর মতো কুপিও ছিল না। মা আইশা (রাহা) বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহর (সা) সালাতের স্থানের সামনে ঘুমাতাম। রাতে যখন তিনি তাহাজ্জুদে দাঁড়াতেন, ঘরে আলো না থাকায় সিজদার সময় তাঁর কপাল আমার মাথায় এসে লাগতো। সিজদায় যাওয়ার সময় আল্লাহর রাসূল আমার পায়ে খোঁচা দিতেন। তখন আমি পা ভাঁজ করে নিতাম, যখন তিনি সিজদা থেকে উঠতেন আমি আবারো পা বিছিয়ে দিতাম।’  
ঘরে কার্পেট বলে কিছু ছিল না। মেঝে বলতে ছিল বালি আর খেজুরের ছোবলা। আল্লাহর রাসূল সেখানেই ঘুমোতেন। তাঁর গায়ে এবড়ো-খেবড়ো ছোবলার দাগ পড়ে যেত। রকমারি আসবাবও ছিল না। মাথার নিচে দেওয়ার মতো একটা চামড়ার গদি ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়তো না ঘরে। তাঁর জীবন দেখলে মনে হতো প্রাচুর্য বলে এই পৃথিবীতে কোনোকিছুর অস্তিত্ব নেই। এই দৃশ্য দেখে একদিন উমার (রা) নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না, কেঁদেই ফেললেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহর কাছে দুআ করুন যেন তিনি এই উম্মতকে প্রাচুর্য দান করেন। পারস্য আর রোমের সম্রাটদের দেখুন, তারা তো আল্লাহর ইবাদত করে না অথচ তারাই আজ ভোগবিলাসে আছে।’ তিনি বললেন, ‘উমার! এটাই কি উত্তম নয় যে তারা দুনিয়ার ভোগবিলাস পেলো আর আমরা আখিরাতের অনন্ত জীবন পেলাম!’ 

আমরা জীবনের প্রাচুর্য দেখে দেখে আক্ষেপ করি কেন অন্য অনেকের সমান কিংবা তার চেয়েও বেশি পরিমাণ নিআমত আমার হলো না, কিন্তু আল্লাহর রাসূলকে (সা) যেন এসব কিছু স্পর্শই করত না। দুনিয়ার ভোগবিলাস, আরাম-আয়েশ আর প্রাচুর্য ছিল তার কাছে একটা মশা কিংবা মাছির চেয়েও তুচ্ছ, কাছে আসলেই হাত দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়ার মতোই তিনি বরাবর একে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছেন। 
 
দারিদ্র্য ছিল আল্লাহর রাসূলের নিত্যসঙ্গী। মা আইশা (রাহা) বলেন, ‘এমনও হয়েছে পরপর তিন চন্দ্রমাস অতিবাহিত হয়েছে, কিন্তু আল্লাহর রাসূলের ঘরে চুলায় আগুন জ্বলেনি।’ এ কথা শুনে তার ভাগ্নে উরওয়া ইবনে আয যুবাইর অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তাহলে সে সময় আপনারা কী খেতেন?’ আইশা (রাহা) জবাব দিলেন, ‘আমরা শুধু পানি আর খেজুর খেয়ে থাকতাম!’ আনাস ইবনে মালিক (রা) বলেন, ‘মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আল্লাহর রাসূলকে কোনোদিন ভুনা গোশত দিয়ে পেট ভরে এক টুকরো রুটি খেতে দেখি-নি।’ 
  
এমন নয় যে, উম্মুল মুমিনীনরা আল্লাহর রাসূলের এই কঠোর আর অনাড়ম্বর জীবনের সাথে অভ্যস্ত ছিলেন না। কিন্তু হিজরি ৯ম বর্ষে এসে আল্লাহ আযযা ওয়া জাল উম্মাহকে খায়বার, মক্কা বিজয়ের মতো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিজয় দান করেন। কুরআনের কিছু আয়াতও নাযিল হয়, যা সীমার মধ্যে থেকে দুনিয়ার নিয়ামত ভোগ করার অনুমতি প্রদান করে। আল্লাহ বলেন, 
“আপনি বলুন, আল্লাহর সাজ-সজ্জাকে, যা তিনি বান্দাদের জন্যে সৃষ্টি করেছেন এবং পবিত্র খাদ্যবস্তুসমূহকে কে হারাম করেছে? আপনি বলুন, এসব নিআমত আসলে পার্থিব জীবনে মু’মিনদের জন্যে এবং কিয়ামতের দিন খাঁটিভাবে তাদেরই জন্যে। এমনিভাবে আমি আয়াতসমূহ বিস্তারিত বর্ণনা করি তাদের জন্যে যারা বোঝে।” (সূরা আরাফ, ৭: ৩২)
  
আয়াতগুলো নাযিল হওয়ার পর উম্মুল মুমিনীনরা মনে করলেন, আল্লাহর নির্ধারিত সীমার মধ্যে থেকে আল্লাহ দুনিয়ায় মু’মিনদের জন্য যা হালাল করেছেন, সেই নিয়ামত ভোগ করায় দোষের কিছু নেই। আদতে এই আয়াতগুলো ছিল মূলত সাধারণ মানুষদের জন্য। আল্লাহ তাআলা চেয়েছেন তাঁর রাসূল (সা) দুনিয়ার উপকরণ থেকে নিজেকে বিরত রাখবেন, বাকিদের মতো তিনি দুনিয়া উপভোগ করবেন না।  
 
“আপনি (কাফিরদের) মাঝে কিছু লোককে ভোগ বিলাসের যে উপকরণ দিয়েছি, তার প্রতি আপনি চোখ তুলে তাকাবেন না। তাদের ব্যাপারে চিন্তিত হবেন না, বরং মু’মিনদের প্রতিই ঝুঁকে থাকবেন।” (সূরা আল হিজর, ১৫: ৮৮)

অনন্ত আখিরাত জীবনের উল্টো পিঠে অতি তুচ্ছ এই নশ্বর পৃথিবীর মায়ায় জড়িয়ে যাওয়া আল্লাহর রাসূলের জন্য কোনোভাবেই শোভনীয় নয়। সূরা আহযাবের উপরোল্লিখিত আয়াত নাযিল হবার পর আল্লাহর রাসূল স্ত্রীদের দুটো রাস্তা খুলে দিলেন -- হয় তারা দুনিয়ার ভোগবিলাস উপভোগ করবেন, অথবা তারা আল্লাহর রাসূলের জীবনসঙ্গী হিসেবে থাকবেন। তারা যদি আল্লাহর রাসূলের সাথে সংসার করেন, তবে বিনিময়ে কষ্ট হলেও লাভ করবেন সবচেয়ে মহান প্রাপ্তি -- আল্লাহর সন্তুষ্টি আর আল্লাহর পক্ষ থেকে এক অসামান্য পুরস্কার। যে নারীরা এতদিন ভরণ-পোষণ বাড়ানোর জন্য চাপাচাপি করতে করতে নবীজিকে প্রায় বিরক্ত করে তুলেছিলেন, এই আয়াত শোনার পর, সেই তারাই প্রত্যেকে একবাক্যে বললেন, ‘আমরা আল্লাহ, আল্লাহর রাসূল (সা) এবং আখিরাতের আবাসকেই বেছে নিলাম।’ আল্লাহ তাদের প্রত্যেকের ওপর সন্তুষ্ট হোন। 
©Rain drops

আরও নতুন পোষ্ট পরবর্তী পোষ্ট

Related Posts

Facebook