সিগনালে বাস থামতেই ডান দিকের বিশাল বিলবোর্ডে চোখ আটকে গেলো আদিবার।
দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ডের স্পন্সরশীপে বেশ কয়েক বছর ধরে অনুষ্ঠিত আলোচিত - সমালোচিত রিয়েলিটি শো এর বিজ্ঞাপন, যার ট্যাগ লাইন হচ্ছে "দেখিয়ে দাও, অদেখা তোমায়"।
তাকে এভাবে বিলবোর্ডের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে পাশ থেকে বান্ধবী লুবনা বলে উঠলো - "আর দুইদিন বাকী আছে, রেজিস্ট্রেশন করবি???
খানিক টা অবাক হয়ে লুবনার দিকে এক ভ্রু উপরে তুলে তাকালো আদিবা -
- কিহহ..!!! আমি জাস্ট দেখছিলাম...
- হুম তো দেখেছিস বলেই তোহ এখন রেজিস্ট্রেশন করবি। শোন, তোর হাইট যথেষ্ট ভালো আছে। এছাড়া ক্যাম্পাস সুন্দরী হিসেবে পরিচিতি তো আছেই। আর মেইন কথা হচ্ছে রেজিস্ট্রেশন করলে তোকে শুধু অডিশন পর্যন্ত ডাকবে... আর অডিশনে গেলেই সবাই ইয়েস কার্ড পেয়ে যায়না। সো, ট্রাই করতে সমস্যা কি...??
আদিবাকে কনভিন্স করতে থাকলো লুবনা।
শেষ পর্যন্ত খানিকটা কৌতূহল আর নতুন কিছু করার আগ্রহ থেকে অনেক টা ঘোরের মধ্যে সেদিনই রেজিস্ট্রেশনটা সেরে ফেললো আদিবা।
ফ্যামেলি মেম্বাররা বিষয়টা কিভাবে
নিবে সেটা নিয়ে সে এখনি চিন্তা করতে চায় না। ঠিক করলো বাসায় আপাতত কিছু জানানোর দরকার নাই..
অডিশন পর্যন্ত গিয়ে ইয়েস কার্ডটা একবার পেয়ে যাক, তারপর সবাইকে বলা যাবে।
অডিশনের দিন নির্ধারিত জায়গায় গিয়ে আদিবা একটু অবাক হয়ে গেলো।
এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার জন্য এতো মেয়ে রেজিস্ট্রেশন করেছে...!!!
সারা রাত জার্নি করে ঢাকার বাইরে থেকেও অনেকে এসেছে।
লম্বা লাইনের পিছনে দাঁড়িয়ে আশে পাশে তাকালো, অনেককেই দেখলো বাবা-মা সাথে নিয়ে এসেছে। মেয়ের শেষ মুহূর্তের মেকআপটা ঠিক আছে কিনা দেখে দিচ্ছিলো কোনো মা। কিংবা ইয়েস কার্ড পেয়ে বের হওয়া উচ্ছ্বসিত মেয়েকে জড়িয়ে ধরছিলো বাবা।
সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার জন্য কোনো বাবা-মা মেয়েকে এভাবে সাপোর্ট করবে বিষয় টা দেখে বেশ অবাকই হলো আদিবা।
- ইউ আর লুকিং সো গর্জিয়াস....
অডিশন রুমে ঢুকে প্রথমেই টেবিলের ওপাশে বসা বাবার বয়সী কারো মুখ থেকে এরকম "কমপ্লিমেন্ট" শুনে বেশ বড়সড় ধাক্কা খেলো আদিবা।
তারপর সেখানে উপস্থিত আরো দুই-তিনজন বিচারকের উদ্ভট, অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন শুনে আদিবা এবার "দেখিয়ে দাও অদেখা তোমায়" এই ট্যাগ লাইনের মূল তাৎপর্য বুঝে গেলো।
হাস্যোজ্জ্বল চেহারা, ভালো হাইট - ভালো ফিগার সব মিলিয়ে বিচারকদের কাছ থেকে সেদিন ইয়েস কার্ডটা পেতে বেশী বেগ পেতে হয়নি আদিবার।
ফেরার পথে বাসে বসে কয়েকবার কার্ড টা বের করে দেখলো।
কিছুটা ভয় আর শংকা কাজ করলেও সে নিজেকে বুঝানোর চেষ্টা করছিলো যে এই ইয়েস কার্ডটা সবার জন্য না। নিজের চোখের সামনেই তো কতো মেয়েকে ইয়েস কার্ড না পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে অডিশন রুম থেকে বের হতে দেখেছে। সে যেহেতু এটা পেয়েছে তার মানে সে এটার যোগ্য.....
নিজেকে এরকম মিথ্যে সান্ত্বনা দিতে দিতে আদিবা ভুলেই গিয়েছিলো যে সে নিজেই নিজেকে কতো বড় ধোঁকা দিচ্ছে।
এতোদিন সম্পূর্ণ কৌতূহল থেকে সব করলেও এই পর্যায়ে এসে একটু একটু করে সুপারস্টার হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে সে।
এক মাস পর...
কয়েক রাউন্ড পেরিয়ে আদিবা এখন সেরা ২০ এ জায়গা করে নিয়েছে। তাদেরকে এখন গ্রুমিং এর জন্য একটা ফাইভ স্টার হোটেলে শিফট করা হয়েছে। এখানে ওদেরকে কিভাবে হাঁটতে হবে থেকে শুরু করে খাওয়ার সময় কিভাবে চামচ ধরতে হবে সব শেখানো হচ্ছে।
আদিবাসহ সেরা ২০ এ জায়গা পাওয়া সব মেয়েরা বেশ ভালো করেই জানে অফিশিয়ালি গ্র্যান্ড ফিনালে হতে আরো দুই তিন রাউন্ড বাকি থাকলেও সেরা মুকুট কার মাথায় যাবে আনঅফিশিয়ালি সেটা এর মধ্যেই সিলেক্ট হয়ে যাবে।
গ্র্যান্ড ফিনালেতে শুধু পূর্ব পরিকল্পিত নাটক মঞ্চস্থ হবে।
বর্তমানে তাদেরকে এই হোটেলে প্রতি রুমে দুইজন করে দশটি রুমে রাখা হয়েছে।
মাঈশা হচ্ছে আদিবার রুমমেট। যতোই রুমমেট হোক না কেন এসব প্রতিযোগিতায় সাধারণত একজন আরেকজনের কম্পিটিটর হিসেবেই থাকে।
সেদিন মাঈশার বাসায় একটা প্রোগ্রাম থাকায় এক রাতের জন্য সে বাসায় যায়।
আদিবা রুমে একা থাকার সুযোগে খানিকটা রিহার্সেল সেরে নিচ্ছিলো।
রাত ১১ টার একটু পরে আদিবার ফোনে এই রিয়েলিটি শো এর মেইন প্রডিউসারের ফোন থেকে একটা কল আসে.....।
সে জানতো আজকে স্যার তাদের এই হোটেলেরই 12th ফ্লোরে উনার পারসোনাল স্যুট এ আছেন।
বাট এতো রাতে স্যারের কল পেয়ে একটু অবাকই হলো। একেবারে লাস্ট রিং এ গিয়ে কল রিসিভ করে ফোনটা কানে ধরতেই ওপাশ থেকে খানিকটা রসিকতার সুরই ভেসে আসলো.....
- মাঈশা যেহেতু রাতে ফিরবে না রুমে একা না থেকে দশ মিনিটের মধ্যে 12th ফ্লোরে আমার স্যুটে চলে আসো.... সেরা মুকুটের ডিলটা সেরে ফেলি....!!!!
কথাটা শেষ হতেই ওপাশ থেকে ফোনের লাইন কাটার শব্দ শুনতে পেলো।
কি বলতে চেয়েছে সেটা বুঝতে খানিকটা সময় লাগলেও সম্বিত ফিরে আসতেই পুরো স্তব্ধ হয়ে গেলো আদিবা।
যদিও সেরা ২০ পর্যন্ত আসতে এরকম ছোটখাটো অনেক পরিস্থিতিই ফেস করতে হয়েছে তাকে।
বাট সুপারস্টার হওয়ার স্বপ্নে বিভোর থাকায় এই বিষয় গুলোকে এতোদিন পাত্তা দেয়নি সে।
এই গিভ এন্ড টেকের দুনিয়ায় কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হবে এটা কেই নিয়ম মনে করে সব মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছে।
কিন্তু আজকে যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে এখন তো মনে হচ্ছে সব কিছুই দিতে হবে।
হঠাৎ খেয়াল হলো প্রডিউসার স্যার দশ মিনিট টাইম দিয়েছিলো।
কি করবে যাবে কি যাবেনা এরকম সাত - পাঁচ ভাবতে ভাবতে রুম থেকে বের হয়ে করিডোর ধরে লিফটের দিকে এগোতে লাগলো।
লিফটে ঢুকে বাটন গুলোর দিকে তাকিয়ে জাস্ট তিন সেকেন্ড ভাবলো গ্রাউন্ড ফ্লোরে যাবে না টুয়েলভথ ফ্লোরে যাবে....??
তিন সেকেন্ড পরেই ডান হাত টা সামান্য বাড়িয়ে G বাটনে প্রেস করলো।
সাথে সাথে অটোমেটিকলি ভিতর থেকে একটা স্বস্তির নিশ্বাস বেরিয়ে আসে। তার মনে হলো সে কতো দিন পর বুক ভরে নিশ্বাস নিচ্ছে।
হোটেল থেকে বের হয়ে একটা ট্যাক্সি ম্যানেজ করে বাসায় রওনা দিলো।
আজকে এক মাস পর যাচ্ছে বাসায়...
সেদিন ইয়েস কার্ড পাওয়ার পরও দুই তিন দিন কাউকে কিছু না জানালেও শেষ পর্যন্ত এক দিন সন্ধ্যায় সাহস করে মাকে জানায় বিষয় টা।
একজন কনজারভেটিভ ফ্যামেলির মেয়ে কিংবা একজন সাধারণ বাঙালি নারী; কোনো জায়গা থেকেই তিনি এই প্রতিযোগিতায় মেয়ের অংশগ্রহণকে স্বীকৃতি দিলেন না।
রাতে অফিস থেকে ফিরে বাবার কানে কথাটা যেতেই তিনিও বিষয় টা কোনো ভাবেই মেনে না নিয়ে অনেক রাগারাগি করলেন।
ফলাফল স্বরূপ দুইদিন পর বাসা ছেড়ে ভার্সিটির হোস্টেলে গিয়ে উঠলো আদিবা।
সেখানে কিছু দিন থাকার পর গ্রুমিং এর জন্য এই হোটেলে এসে উঠেছিলো। সেদিনের পর থেকে ফ্যামিলির সাথে কোনো কন্টাক্টই করেনি। স্বপ্ন দেখছিলো সুপারস্টারের মুকুট পড়ে বাবা-মা'র সামনে দাঁড়ালে হয়তো সব কিছু মেনে নিবে।
ট্যাক্সিতে বসে এসব কিছু ভাবছিলো হঠাৎ বাম দিকের বিশাল বিল বোর্ডে চোখ পড়লো।
রাতের এই শহরে জ্যাম না থাকায় গাড়ি না থামলেও এক পলক দেখে বুঝতে কষ্ট হয়নি যে এটা এই সুন্দরী প্রতিযোগিতারই বিজ্ঞাপন।
যেখানে তাদের সেরা ২০ জনের ছবি দিয়ে পরবর্তী পর্ব দেখতে অমুক টিভি চ্যানেলে চোখ রাখতে বলা হয়েছে।
তাচ্ছিল্য মার্কা একটা হাসি দিয়ে মুখ টা ফিরিয়ে নিলো। প্রথম যেদিন এই বিলবোর্ডে চোখ পড়েছিলো সেদিন যদি কৌতূহলী না হতো আজকে হয়তো এই পর্যায়ে এসে তার চোখে ঘৃণাটাও থাকতো না।
রাত ১২.৪০ মিনিটে কলিংবেলের শব্দ শুনে ঘুম ভাঙলো আসাদ সাহেবের।
এতো রাতে কে আসতে পারে এটা ভাবতে ভাবতে ড্রয়িং রুম পেরিয়ে মেইন দরজার লুকিং গ্লাসে চোখ রাখলেন।
সিঁড়ি ঘরের আবছা আলোয় ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছায়া মূর্তি টা কে তার আদিমনির মতো লাগলেও বেশ বিধ্বস্ত মনে হচ্ছিলো। তিনি বেশ স্বাভাবিকভাবেই দরজা খুলে দিলেন।
বিশ বছর কোলে পিঠে আদর করে বড় করা তাদের আদিমনি কে মাত্র এক মাসের ব্যবধানে ভীষণ অপরিচিত লাগছিলো।
গলার আওয়াজ টা স্বাভাবিক রেখেই বললেন...
- ভিতরে এসো।
স্তব্ধ হয়ে থাকা আদিবা বাবাকে পাশ কাটিয়ে মাথা নিচু করে ভিতরে ঢুকতেই ডাইনিং টেবিলের সামনে মাকে দাঁড়ানো দেখতে পেলো।
এক হাতে চেয়ার ধরে ঠকঠক করে কাঁপছেন আর চোখ দিয়ে নিঃশব্দে অশ্রু ঝরছে।
এটা কি হারানো সন্তান নীড়ে ফিরে আসা উপলক্ষে আনন্দের অশ্রু নাকি রাগ - ক্ষোভের অশ্রু আদিবা বুঝতে পারলো না।
ততোক্ষণে দরজা লাগিয়ে বাবা পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন।
বেশ গম্ভীর অথচ স্বাভাবিক গলায় বললেন...
- এতো রাতে কেন এভাবে ছুটে এসেছো সেটা খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পারছি।
এক মাস আগেই আমাদের কাছে আমাদের আদিমনি মৃত হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু আজকে আল্লাহ তোমাকে হেদায়াত দিয়েছেন। তুমি নিজেই ভুল বুঝতে পেরে ফিরে এসেছো। আল্লাহ তা'য়ালা যেহেতু তোমাকে আরেক টা সুযোগ দিয়েছেন...তাই আমাদেরও দিতে আপত্তি নেই।
এতোক্ষণে মা এগিয়ে এসে খানিক টা শব্দ করে কেঁদে জড়িয়ে ধরলেন তার আদিমনি কে।
সেদিনের পর থেকে নিজেকে একদম ঘরবন্ধি করে ফেলে আদিবা।
এমনিতেই গত এক মাসে ভার্সিটিতে অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। তাই এই সেমিস্টারটা ড্রপ দিতে হবে। বাসায়ই সারাক্ষণ বই পড়ে আর মায়ের সাথে গল্প করে সময় কাটাতে লাগলো।
প্রায় পনের/বিশ দিন পর একদিন সকালে ড্রয়িং রুমে বসে পত্রিকা পড়ছিলো।
বিনোদন পাতা উল্টাতেই লাল কালির বড় হেডলাইন টা তে চোখ আটকে গেলো যেখানে লেখা ছিলো "শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পেলো সাবা"। সাথে মুকুট মাথায় দেয়া সাবার হাস্যোজ্জ্বল ছবি।
গ্রুমিং এর জন্য যে হোটেলে উঠেছিলো সেখানে তার দুই রুম পরেই থাকতো সাবা নামের এই মেয়েটি। সেদিন রাতে প্রডিউসার স্যারের ফোনটা তাহলে আদিবার পরে সাবার কাছেই গিয়েছিলো।
একটু মুচকি হেসে সেখান থেকে চোখ সরিয়ে জানালার বাইরে খোলা আকাশের দিকে তাকায় আদিবা...
পরিস্ফুট স্বরে বলে উঠলো - আলহামদুলিল্লাহ...!!!!
#রৌদ্রময়ী_গল্প
দেখিয়ে দাও, অদেখা তোমায়
- সুমাইয়া জহির

লেখক: 
