333

ডিপ্রেশন আল্লাহর একটি অন্যতম নিয়ামত!

ডিপ্রেশন আল্লাহর একটি অন্যতম নিয়ামত!
.
কালের পরিক্রমায় লক্ষ কোটি মানুষ এসেছেন পৃথিবীতে। কিন্তু কেউই কখনো পুরোপুরি সুখী জীবনযাপন করতে পারেন নি। দুনিয়ার ভোগ-বিলাসী জীবন-যাপন করা উচ্চ শ্রেনীর মানুষগুলোও ডিপ্রেশনে ভোগেন। তেমনি নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষও ডিপ্রেশন এর স্বীকার! মোটকথা, ৮০% মানুষেরও বেশি মানুষ ডিপ্রেশন এর মতো তিক্ত অনুভূতির স্বীকার হয়!
.
পয়েন্ট আকারে আলোচনা করার চেষ্টা করবো যেন বিষয়টি তুলনামূলক সকলের কাছে সহজ হয়।
এবং যেন আপনারা নিজেরাই নিজেদের জীবনের কষ্টগুলোর সমাধান খুঁজে নিতে পারেন। আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু এই ডিপ্রেশনকে ঘিরেই।
তো চলে যাই মুল আলোচনায়।
.
১. ডিপ্রেশনঃ
ডিপ্রেশন বা বিষন্নতা হচ্ছে এমন একটি বিষময় তিক্ত অনুভূতি যা হৃদয়কে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দেয়, এবং পারিপার্শ্বিক জীবনের গতি থামিয়ে দেয়। প্রত্যেকটি মানুষই জীবনটাকে সুন্দরভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখে। জীবনকে সুন্দরভাবে সাজাতে চায়। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে জীবনের সেইসব লক্ষ্যগুলো ব্যর্থ হয়ে যায়। ফলস্বরূপ জীবনের প্রতি একটা হতাশা চলে আসে। হতাশার দীর্ঘসময় চলাকালীন পরিস্থিতিকেই মুলত ডিপ্রেশন বলা হয়।
.
২. ডিপ্রেশন এর কারনঃ
পৃথিবীর লাখো কোটি মানুষের হতাশার কারনও ভিন্ন ভিন্ন হয়। তবে কারনগুলোকে নির্দিষ্ট কয়েকটি শ্রেনীতে বিভক্ত করা যেতে পারেঃ
▪ চিরচেনা ও কাঙ্ক্ষিত প্রিয়জনের হারিয়ে যাওয়া অথবা অস্বাভাবিক আচরণ।
▪বহুদিনের কিছু স্বপ্ন বাস্তবায়িত না হওয়া এবং বাস্তবায়নের সকল পথ বন্ধ হয়ে যাওয়া।
▪ক্যারিয়ার গঠনের উপায় খুঁজে না পাওয়া অথবা চাকুরীক্ষেত্রে অবনতি।
▪নিকটাত্মীয়ের আকষ্মিক মৃত্যু।
▪বৈবাহিক জীবনের নানা ধরনের জটিলতা।

এগুলো বাদেও আরও অনেক কারন থাকতে পারে, যেগুলো ক্রমাগত জীবনে চলার পথে বাধাগ্রস্ত করে। জীবনকে স্বাভাবিক গতিতে এগিয়ে নিতে দেয় না সেগুলোই ডিপ্রেশন।
.
৩. ডিপ্রেশন যেভাবে আমাদের জীবনের গতি থামিয়ে দেয়ঃ
ডিপ্রেসড মানুষ বর্তমান সময়ে জীবন কাটালেও তারা সবসময়ই চিন্তা করেন অতীত নিয়ে। অতীতের ব্যর্থতা নিয়েই তারা ভাবনায় ডুবে থাকেন এবং ক্রমাগত কষ্ট পান।
তারা প্রায়শই ভাবে যে অতীতের পাওয়া যন্ত্রনাগুলোর জন্য তারা নিজেরাই দায়ী এবং তারা যদি আরেকটু চেষ্টা করতেন তবে কখনোই বিষময় অনুভূতির স্বীকার তাদেরকে হতে হতো না। অথচ প্রকৃত অর্থে তারা নির্দোষ হলেও তারা প্রত্যেকটা কষ্টের মুহূর্তের কথা ভাবতে থাকেন এবং নিজেদের দোষারোপ করেন। তারা বর্তমানে থেকেও যেন অতীতেই বেঁচে থাকেন। যা তাদের সাধারণ জীবনকে বাধাগ্রস্ত করে দেয়।
.
৪. ডিপ্রেশন মারাত্মক ব্যাধিঃ
জীবনে কিছু কিছু বিষ আছে যা জীবিত আত্মাকে মৃতপ্রায় করে দেয়! ডিপ্রেশন তেমনই একটি আত্মিক ব্যাধি, যার বিস্তৃতি প্রত্যেকটা ব্যক্তির জীবনের বেঁচে থাকার ইচ্ছেটুকুও বিনষ্ট করে দেয়। স্বাভাবিক জীবন তাদের কাছে রোবটিক মনে হয়, হাসি ও আনন্দের মুহূর্তগুলো তাদের কাছে আকষ্মিক হয়ে যায়। যে কোন এক বিষয় নিয়ে মনক্ষুন্ন হয়ে বিষাদগ্রস্ত জীবনযাপন করা শুরু করে! দুর্বল হৃদয়ে ডিপ্রেশনের সর্বোচ্চ শক্তিধর প্রভাব বিস্তার করে। সারাক্ষণ একটা কালো ছায়া এসে জীবনটাকে পুরোপুরি ঢেকে দেয়।
কারো কারো কাছে জীবন মানেই যেন ব্যস্ততা-ঘুম-আর রোবটিক জীবনযাপনকে বোঝায়।
.
৫. ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে ডিপ্রেশনের প্রভাবঃ
▪হতাশাগ্রস্ত মানুষেরা অনেক একাকিত্বে ভোগেন। তারা সহজে কষ্ট ভুলে স্বাভাবিক আচরণ করতে পারেন না।
▪ডিপ্রেসড মানুষের কাছে তাদের সমস্যাগুলো অনেক বেশি বিরাট আকার ধারণ করে এবং তারা সেই সমস্যাগুলোর সমাধান খুঁজে পায় না। এমনকি সমস্যাগুলো তাদের কাছে এতোটাই জটিল মনে হয় যে তারা কারো সাথেই সমস্যাগুলো শেয়ার করতে চান না। এবং মাইন্ড সেট করে নেন যে,  এটাই আমার জীবন এবং আমার জীবনে আর কোন সুখ অবশিষ্ট নেই।
▪হতাশা মানুষের বিশ্বাস যোগ্যতা কেড়ে নেয়। হতাশাগ্রস্ত মানুষেরা কাউকেই ভরসা করার মতো আস্থা খুঁজে পান না।
▪বিশেষতঃ যেই সকল মানুষের হতাশা কোন ব্যক্তিকেন্দ্রিক, অর্থাৎ কোন প্রত্যাশিত ব্যক্তির কাছে প্রতারিত হয়েছেন, তারা প্রায় দিনের অধিকাংশ সময়ই অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতাগুলো নিয়েই ভাবতে থাকেন।
তারা নিজেদের খুঁত খুঁজে বের করতে চান এবং কেন তারা প্রতারিত হয়েছেন সেই কারণ খুঁজতে থাকেন। ৮০% মানুষই যারা পুরনো স্মৃতি আঁকড়ে ধরে থাকেন তারা ভাবতে পছন্দ করেন যে প্রতারক ব্যক্তি নিজের ভুল বুঝতে পারবেন এবং আবার একটা সুন্দর জীবন তাদেরকে উপহার দিবেন। তাই তারা অহেতুক সেই প্রতারকের জন্যই অপেক্ষা করেন এবং নিজেদেরকে অন্যদের কাছ থেকে গুটিয়ে রাখেন।
.
৬. ডিপ্রেশন দূর করার বহুল ব্যবহৃত কিছু অকার্যকরী সমাধানঃ
▪কোন কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখা।
➡ বহুল ব্যবহৃত এই ধারণাটি সাময়িক নিরাময় হলেও এটা উপযুক্ত কোন সমাধান নয়। সারাদিনের কর্মব্যস্ততা সেরে একটা মানুষ ঘুমাতে গেলেও ক্লান্তিতে চোখে ঘুম এনে দিলেও বাস্তবিক অর্থে এটা ডিপ্রেশন কাটানোর জন্য কোন ভূমিকা পালন করে না। নিজেকে ব্যস্ত রাখা মানেই নিজেকে ডিপ্রেশন থেকে তাড়িয়ে বেড়ানো, আত্মাকে ব্যস্ততা দিয়ে বুঝ দেয়া যায় না। সমস্যাটা যেখানে আত্মার, দেহকে পরিশ্রম করিয়ে আত্মিক সমাধান লাভ করা অসম্ভব। অতি ব্যস্ততা জীবনের মূল আনন্দ থেকেই দূরে সরিয়ে নেয়।
▪মুভি দেখা/গান শোনা।
➡ আগে যখন গান শুনে মন ভালো করতে চাইতাম তখন গান উল্টো মন আরও খারাপ করিয়ে দিতো। স্মৃতি বিজড়িত কথাগুলো বারবার গানের লিরিক্সে ভেসে উঠতো। মুভি/গান কোনটাই ডিপ্রেশন দূর করতে পারে না। বরং আরও অধিক মাত্রায় হতাশ করে তোলে।
▪বেশি বেশি ঘুরতে যাওয়া।
➡ মন খারাপ নিয়ে ঘুরতে যাওয়া সাময়িক মন ভালো করতে পারে। কিন্তু ডিপ্রেশনকে নিরাময়ের জন্য আরও জোড়ালো পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।
▪বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের সাথে সময় কাটানো।
➡ অবশ্যই এটি সুন্দর আইডিয়া। কিন্তু দিনশেষে নিজেকেই যখন নিজের মুখোমুখি হতে হয়, তখন ডিপ্রেশন ভুলে থাকা আর সম্ভব হয় না।
.
.
.
★ অনেক বেশি লিখে ফেলেছি, এবার চলে আসি সবচেয়ে আকর্ষণীয় পয়েন্ট এ। কেউ যদি জীবনে কাজে লাগাতে পারেন অবশ্যই ডিপ্রেশন কাটিয়ে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে পারবেন। এবং জীবনের ডিপ্রেশন পরবর্তী সময়গুলোই হয়ে উঠবে স্বর্নের চেয়েও মুল্যবান!
দেরী না করে শুরু করা যাক।
.
১. আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়াঃ
মানুষের কাছে কষ্ট শেয়ার করার পূর্বে মনের সবটুকু কথা নিংড়ে দিন আল্লাহর কাছে। একটু ছিটেফোঁটাও যেন বাকি না থাকে।
সবকিছু খুলে বলুন। যদিও আল্লাহ সব কিছুই জানেন, তবুও তিঁনি আপনাকে সুযোগ দিয়ে দেখেন যে আপনি তার উপর কতটা নির্ভর করেন, কতখানি আস্থাশীল।  সুখ ও শান্তির মালিক আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা। পৃথিবীতে কারো সাধ্য নেই একজন মানুষকে শান্তি এনে দেয়ার! অশান্ত হৃদয় নিয়ে আল্লাহর কাছে সব খুলে বলুন, নফল সালাতের লম্বা সিজদাহ্ তে কেঁদে কেঁদে সবকিছু বলে দিন! ততক্ষণ কাঁদবেন যতক্ষন না মন হালকা হয়।
চোখের পানি মনের বোঝা কমিয়ে দেয়। একসময় নিজেই অনুভব করবেন যে, আপনি আর কাঁদতে পারছেন না, ইচ্ছে করলেও কান্না আর আসবে না। 
আল্লাহকে কষ্টের কথা জানিয়েও আপনি কষ্টে পড়ে থাকবেন তা অসম্ভব!
.
২. ইস্তেগফার করাঃ
ইস্তেগফার বলতে ক্ষমা চাওয়াকে বোঝায়, আপনার মনের দুঃখগুলো আল্লাহর কাছে জানানোর পরপরই আপনার এমন ভুল খুঁজুন যা আল্লাহ পছন্দ করেন না। অন্যায় স্বীকার করুন।
তওবা বা ইস্তেগফার আমাদের অন্তরে অনুশোচনাবোধ সৃষ্টি করে।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লার কাছে অনুতপ্ত বান্দার চোখের পানির ফোঁটা অনেক বেশি প্রিয়। গুনাহগার বান্দা যখন চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে অপরাধ স্বীকার করে নেয়, তখন পরম করুনাময় পাপী বান্দার চোখের পানি নাকের ডগা বেয়ে জমিনে পড়ার আগেই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা তার সকল পাপ ক্ষমা করে দেন! সুবহান-আল্লাহ!!!
ফলাফল স্বরুপ পাপী বান্দার অন্তরে শান্তির পরশ ধীরে ধীরে বয়ে যেতে থাকে।
.
৩. নিয়মিত ইবাদত করাঃ
পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, দৈনিক ছোট ছোট সুন্নাহ প্র‍্যাকটিস জীবনকে সুশৃঙ্খল করে তোলে৷ পাশাপাশি অধিকমাত্রায় ইস্তেগফার বান্দার দুআ কবুলের পথে উত্তম ভূমিকা পালন করে। যে ব্যক্তি আন্তরিকতার সাথে ইবাদত করে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা তার সকল সমস্যার সমাধান নিজেই করে দেন। সবসময় আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুলকারী ব্যক্তি পরপর বিপদে পড়লেও ভরসা রাখেন যে আল্লাহ উত্তম কিছু ব্যবস্থা করছেন। অতিরিক্ত নফল ইবাদতের প্র‍্যাকটিস এর আগে দৈনিক ফরজ সালাতটুকু নিয়মিত আদায় করা উচিত! নামাজই আল্লাহর নৈকট্য লাভের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি কার্যকর উপায়!
.
৪. ক্ষমা করাঃ
ব্যাপারটা দেখতে সহজ মনে হলেও বাস্তব পরিসরে এটার পালনই সবচেয়ে কঠিন। উদার হৃদয় ব্যতীত কেউই প্রতারিত হওয়ার পরেও প্রতারককে ক্ষমা করে দিতে পারে না। সবচেয়ে বেশি কঠিন ও শান্তি লাভের জন্য ১০০%কার্যকরী উপায় হচ্ছে ক্ষমা করে দেয়া।
 প্রিয় ভাই ও বোনেরা!
ক্ষমা মানুষের অন্তরকে শুদ্ধ করে এবং মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্ত করে দেয় খুবই দ্রুত। একদিনেই ক্ষমা করার মতো মনভাব জন্মাবে না অবশ্য, এটা প্র‍্যাকটিস করে যেতে হবে একটু একটু করে।
যেদিন আপনি আপনার সাথে অন্যায়কারীকে ক্ষমা করে দিয়ে দায়মুক্ত হবেন।
শুধুমাত্র সেদিনই ডিপ্রেশন থেকে উদ্ধার হওয়ার রাস্তা গুলো এক এক করে খুলে যাবে।
.
🔳 প্রিয় কিছু আয়াতের মাধ্যমেই আজকের এই লেখা শেষ করছি।
ডিপ্রেশন আল্লাহর দেয়া নিয়ামত, যার মাধ্যমে জীবনের দুটো দিকই অনুভব করা হয়ে যায় এবং ডিপ্রেশন পরবর্তী সময়গুলো এতোটাই সুন্দর হয় যে, অতীতের ডিপ্রেশনই জীবনের এগিয়ে যাওয়ার পথ উন্মোচন করে দেয়!
আল্লাহ সকলের কষ্ট দূর করে দিয়ে উত্তম জীবনযাপন করার সুযোগ দান করুন। আমার জন্যও দুআ চাই!
.
▪" নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্য্যশীলদের সঙ্গে রয়েছেন ।"
( সূরা বাকারা ২ : ১৫৩ ) ।

▪" আর তোমরা নিরাশ হয়োনা এবং দুঃখ করোনা । যদি তোমরা মুমিন হও তবে তোমরাই জয়ী হবে ।"
( সূরা ইমরান ৩ : ১৩৯ ) ।

▪" যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর নির্ভর করে, আল্লাহই তার জন্য যথেষ্ঠ ।"
( সূরা তালাক ৬৫ : ৩ ) ।

▪" আল্লাহ কষ্টের পর সুখ দেবেন ।"
( সূরা তালাক ৬৫ : ৭ ) ।

▪" নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে স্বস্তি রয়েছে । অবশ্য কষ্টের সাথেই স্বস্তি আছে । "
( সূরা ইনশিরাহ ৯৪ : ৫-৬ )

লেখাঃ আলিজা বিনতে কাদের

আরও নতুন পোষ্ট পরবর্তী পোষ্ট

Related Posts

There is no other posts in this category.

Facebook